খাবার হচ্ছে এমন একটি জিনিস যা শুধু আমাদের ক্ষুধাই নিবারণ করে না সাথে এটি আমাদের নানা ধরনের ইন্দ্রিয় জাগ্রত করে দেয় এবং একই সাথে কোন একটি জায়গার সম্পর্কে একটি স্মৃতি তৈরি করে। সেই খাবার যদি সুস্বাদু হয় তবে আমাদের সেই স্মৃতি হয় চমৎকার আর খাবার যদি কোনো কারণে আমাদের আশানুরূপ না হয় তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের সেখানকার স্মৃতি ঠিক তেমন চমৎকার হয়না। 

পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সবসময়ই ডিনার করার সময়। কোন একটি দেশের ঘুরতে যাওয়ার পেছনে সেখানকার চমৎকার প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম সৌন্দর্য গুলো যেমন ভূমিকা রাখে তেমনি পাশাপাশি সেই দেশের বিভিন্ন রকম মজাদার খাবার কিংবা খাদ্যাভ্যাস একই রকম ভাবে ভূমিকা রাখে। রোমে গিয়ে আপনি রোমান ফোরামে ঠিক যেখানে সিজার হেঁটেছিলেন সে জায়গাগুলোতে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাঁটতে পারেন এবং একই সাথে সিস্টিন চ্যাপেল এ মাইকেলেঞ্জেলোর করা স্বর্গীয় কারুকার্য এরদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মতো রোমাঞ্চকর কাজ করতে পারেন। কিন্তু তারপরও এখানকার খাদ্যাভ্যাস ও খাবারের যে মেনু তা আপনি ভুলতে পারবেন না। কোন একটি জাতি কিংবা দেশ বা মহাদেশ কতটা সুন্দর তা বোঝার কিংবা জানার জন্য চমৎকার একটি উপায় হচ্ছে তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানা এবং তাদের খাবারের মেনু ট্রাই করে দেখা।

কোন একটি স্থানের খাবার শুধু সে জায়গার স্মৃতিই রোমন্থন করায় না, খাবার কোন জায়গার অতীত এবং গভীর ইতিহাস সম্পর্কে তুলে ধরে। কোন একটি দেশ বা জাতির তাদের ভাষা, পোশাক এমনকি তাদের ধর্ম পরিবর্তন করার পরেও যে জিনিসটি তাদের স্বকীয়তা তুলে ধরতে সক্ষম সেটি হচ্ছে সে দেশ বা জাতির খাদ্যাভাস এবং তাদের খাবার সমূহ। বিশেষ করে তরতাজা খাবারের যে বাজার রয়েছে সেগুলো কোনো দেশ বা জাতির অতীত এবং ভবিষ্যৎ এর পরিচয় বহন করে। 

কোন দেশ বা মহাদেশে যখন কোন পর্যটক ঘুরতে যায় তখন সেখানকার এ খাবারগুলো এবং সেখানকার মানুষের যে খাদ্যাভ্যাস রয়েছে সেগুলোর সাথে সেই পর্যটকদের একটি বিশেষ এবং গভীর সম্পর্ক হয়ে যায়। কারণ কোন একটি জায়গায় গিয়ে সবকটি আশ্চর্যজনক স্থান ঘুরতে পারা না গেলেও প্রতিবেলায় সেখানকার খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিল রেখে পর্যটক এর সেখানকার প্রচলিত খাবার খেতে হয়। এতে করে যতদিন সে জায়গায় থাকা হয় সেখানকার খাবার এর সাথে একটি পরিচিতি হওয়ার সাথে সাথে খাবার গুলোর সাথে স্মৃতি তৈরি হয়। এ কারণে কোন একটি দেশের বা জাতির অথবা কোন মহাদেশের খাবার সমূহ এবং সেখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস সে জায়গার অতীত, বর্তমান সম্পর্কে জানতে যে কাউকে বেশ ভূমিকা পালন করে। 

আমাদের এই দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাসের লিখার সিরিজ এ আমরা বিভিন্ন দেশ মহাদেশ কিংবা জাতির খাবার সমূহ এবং তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে লিখে যাব এবং এগুলো সম্পর্কে যে মজার মজার তথ্য গুলো আপনি জানার জন্য আগ্রহী হতে পারেন সেগুলো আমাদের এই দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজ থেকে আপনি খুব সহজেই পড়তে পারবেন। 

এশিয়ানদের খাদ্যাভাসের কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। তার মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয় গুলো আছে সেগুলো নিয়ে কিছু তথ্য জানাচ্ছি।

হাত দিয়ে খাওয়া

এশিয়ানরা দিনে তিনবার খাবার খায় আর এখানে তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস হচ্ছে হাত দিয়ে খাওয়া। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো সাধারণত এশিয়ার সব দেশ এ চামচ বা ছুরি ব্যবহার করে খাওয়া হয় না বরং এখানে বেশিরভাগ দেশে হাত দিয়েই খাবারের কাজ সম্পন্ন করা হয়। তবে এখানে যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ ডানহাতি সেহেতু ডানহাত দিয়ে খাবার খাওয়া হয় এবং এক্ষেত্রে দুই হাত দিয়ে খাওয়ার কাজ করা হয় না। 

চপস্টিক ও চামচ

আপনি যদি খাওয়ার সময় আপনার আঙ্গুল পরিষ্কার রাখতে চান এবং সোজা কথায় হাত দিয়ে খেতে না চান তবে এ তথ্যটি আপনার জন্য বেশ উপকারী হতে পারে যদি আপনি এশিয়ায় ঘুরতে আসেন। এশিয়ান দেশগুলোর সবখানেই হাত দিয়ে খাওয়া হয়না অনেক জায়গায় চপস্টিক এবং চামচ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেসব দেশগুলোতে আপনি হাত দিয়ে খাওয়ার পরিবর্তে খুব সহজেই এগুলো ব্যবহার করে খাবার খেতে পারবেন। তবে আপনার যদি হাত দিয়ে ক্ষেত্রে কোন ধরনের সমস্যা না থাকে তাহলে এশিয়ান খাদ্যাভ্যাস হতে পারে আপনার জন্য খুবই পছন্দের এবং চমৎকার একটি খাদ্যাভ্যাস।

শুধু ভাত খাওয়া 

এশিয়ানদের একটি অদ্ভুত খাদ্যাভ্যাস হচ্ছে তারা দিনে তিনবেলা খাবার এই ভাত খেয়ে থাকে। অন্যান্য মহাদেশ বা দেশের মানুষের কাছের এই বিষয়টি অদ্ভুত লাগলেও তাদের কাছে সকালে দুপুরে এবং রাতে ভাত খাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যপার। এবং অনেকের কাছে হয়তো মনে হতে পারে তিনবেলা এভাবে ভাত খেলে চরম পরিমাণের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকতে হতে পারে কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এশিয়ান তিনবেলা ভাত খেয়েও সুস্থ ও চিকন হয়ে থাকে।

গরম চা

এশিয়ানদের আরেকটি খাদ্যাভ্যাস হচ্ছে গরম চা খাওয়া এবং এ কাজটি তারা দিনে বহুবার করে থাকে। সকালে দুপুরে রাতে খাওয়ার আগে পরে কিংবা কাজের ফাঁকে সময় পেলেই এশিয়ানরা চা খেয়ে থাকে।

ঝাল

আপনি যদি এশিয়াতে একজন পর্যটক হিসেবে যান এবং আপনি অতিরিক্ত ঝাল খেতে পারদর্শী না হন তবে খাওয়ার সময় সবচেয়ে কম ঝাল এর খাবারটি খেতে বসলেও আপনি ঝালের চোটে ঘামতে শুরু করবেন। এশিয়ান রাত খাবার ঝাল খেতে এত বেশি পছন্দ করে যে তাদের সবচেয়ে কম ঝালের খাবার টিও অনন্য মহাদেশে মানুষের কাছে প্রচুর ঝাল লাগতে পারে।

ভাগ করে খাওয়া

এশিয়ান দের খাদ্যাভ্যাসের খুব সচরাচর একটি বিষয় হচ্ছে একজনের সাথে অন্যজনের খাবার ভাগ করে খাওয়া। এশিয়ায় খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় একজন মানুষ কোন খাবার কিনে তার সাথের মানুষকে তার কোন ভাগ না দিয়ে পুরোটাই একাই খেয়ে ফেলছে। বরং একজন খাবার খেলে সেটি তিনি অপর জনের সাথে ভাগাভাগি করে খান। এবং খাবার খেতে খেতে তাদের গল্প করার যে অভ্যাস সেটি খুবই চমৎকার একটি খাদ্যাভ্যাস হিসেবে ধরা যায়। 

এশিয়ানদের এই খাদ্যাভ্যাস গুলো মনে রাখলে হয়তোবা আপনি যদি কখনো এশিয়ার কোন দেশের ঘুরতে যান তবে হয়তো কখনও এই তথ্যগুলো সাহায্য করতে পারে।

আগের পর্বগুলো তে আমরা দেশ-বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের লেখা হিসেবে ইউরোপে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপার এ কিছু তথ্য জেনেছি। এই পর্বে আমরা ইউরোপে বসবাসকারী মানুষদের বর্তমান কিছু খাদ্যাভ্যাস এবং সেগুলো কিভাবে তাদের মাঝে এসেছে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করব।

 ইবেরিয়ান নাবিকগণ ইউরোপের খাদ্যাভ্যাসের একরকম বিপ্লবই ঘটিয়েছেন বলা চলে। আর এই বিপ্লবের মূল হোতা হিসেবে কাজ করেছে নতুন বিশ্ব থেকে তাদের খুঁজে পাওয়া বেশ কিছু খাবার এর উপকরণ এবং নানা রকম খাবার এর রেসিপি। মধ্য ইউরোপের আলু থেকে পুরো ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয় এগুলোর মধ্যে রয়েছে সুইস রোস্টি, মিউনিখ এর রিবার্কনোডেল ডাম্পলিং, বুলগেরিয়ার রোডোপ পাহাড়ের পাটানিক পাই। এই খাবারগুলো যেমন অনান্য খাবারের থেকে আলাদা তেমনি এগুলোর মাঝে রয়েছে ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ এবং গুনাগুন। 

নতুন বিশ্বের নতুন সব খাদ্য উপকরণ এর মত গোল মরিচ এবং মিষ্টি টমেটোর উপকরণের তৈরি হয় সেভিল এর সতেজকারক ঠান্ডা সালাদ স্যুপ গাজপাচো। নতুন পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের টমেটোর সহ অন্যান্য অনেক উপকরণের ওপর বেশ রূপান্তরকারী ভূমিকা রয়েছে আর এ কারণে মোজারেলা চিজ, সুগন্ধি বেসিল এবং অলিভ অয়েল দিয়ে চমৎকার সব খাবার তৈরি করা সম্ভব হয়। যেমন একটি পাউরুটির ওপর একই ধরনের উপাদান দিয়ে খাবার তৈরি করুন কিন্তু সাথে টমেটোর কিছু উপাদান মিশ্রিত করে দিয়ে হালকা করে রান্না করলে এর সংমিশ্রণে যে সুস্বাদু খাবার তৈরি হয় তা একদম মুখে লেগে থাকবে। আর এভাবেই তৈরি হয় নেপলস এর বিখ্যাত মার্গারিটা পিজ্জা যেটা সারা বিশ্বব্যাপী ইউরোপের খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাসকে চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলছে।

এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রাপ্ত এবং নিজেদের ভূমিতে উৎপন্ন উপকরণ দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন প্রকারের খাবার তৈরি করা হয় যেগুলো স্বাদে অনন্য এবং ইউরোপের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সেখানকার বৈচিত্রতা বহন করে। শুধু যে ইউরোপে ঘুরতে যাওয়া পর্যটক সেখানকার এই খাবার গুলো এবং তাদের খাদ্যাভ্যাস এর সাথে পরিচিত হয় তা নয় বরং ইউরোপের এর সকল খাবার পুরো পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এর মাধ্যমে ইউরোপের অতীত এবং বর্তমানের তুলে ধরেছে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। আর এটির জন্য প্রধান অবদান ইউরোপিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের খাবারের। 

ইউরোপের খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের খাবারের কথা হয় তো বলে শেষ করা যাবেনা। তারপরও আমরা কিছুটা চেষ্টা করেছি আপনাদেরকে ইউরোপের বিভিন্ন খাবার এবং তাদের কিছু খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে আপনাদের জানানোর জন্য। আমাদের দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের যে লেখাগুলো তার বাকি পর্বগুলো আমরা চেষ্টা করব অন্য উপমহাদেশ বা মহাদেশ এবং বিভিন্ন দেশ ও জাতির জাতীয় খাদ্য এবং তাদের চমৎকার সব খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আপনাদেরকে কিছু তথ্য জানানোর। যে তথ্যগুলো জানলে আপনি বাজে কোন পর্যটক সেই জাতি কিংবা দেশের মানুষের অতীত এবং বর্তমানের নানা তথ্য জানতে পারবেন। তাই আমাদের এই দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের বাকি পর্বগুলো পড়তে নজর রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।

আমাদের এই দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের লেখার আগের  পর্বটিতে আপনারা ইউরোপে খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনেছিলেন। আমাদের এই দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের এই পর্বে আমরা ইউরোপের খাদ্যাভ্যাসের আরো কিছু তথ্য নিয়ে হাজির হয়েছি।

একজন পর্যটক যখন কোন দেশে ঘুরতে যান তখন সে দেশের জায়গার সাথে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি অন্য যে জিনিসটি তার মন আকর্ষণ করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটি হচ্ছে সে জায়গার বিশেষ এবং অতি পরিচিত খাবার। তেমনি ভাবে বলা যায় ইউরোপের রাঁধুনিদের ভাপ দিয়ে তৈরি করা মাছের এক প্রকার খাবার যেটি সেখানকার বন্দরগুলোর ঐতিহ্য বহন করে থাকে। এছাড়াও সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে মার্সেই শহরের রুইলি মাছের রসুন দিয়ে তৈরি করা কাঁটাযুক্ত বুদবুদময় বোলাবেইস খাবারের কথা যেটি এই শহরের ঐতিহ্য বহন করে। একইভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে বার্সেলোনার জারজুয়েলা মাছের কথা যেটা দিয়ে এই শহরের ঐতিহ্যবাহী এবং সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হয় যা কিনা পর্যটকদের মন কাড়তে বাধ্য। 

এছাড়া ইউরোপের উত্তরে থাকা বেলজিয়ামের নদীগুলো থেকে পাওয়া এক ধরনের সাদা মাছ দিয়ে তৈরি করা হয় ওয়াটারজুই। আর এই তিন ধরনের ভাপে সিদ্ধ করে রান্না করা মাছ যার উপরে কিনা স্যাফ্রন দিয়ে অন্য রকম সুস্বাদু করে তোলা হয় সেগুলো এই জায়গাগুলোর চমৎকার ঐতিহ্যবাহী এবং প্রসিদ্ধ খাবার। আর ইউরোপের এই খাবারগুলোর ওপরে ক্রোকাস দিয়ে তৈরি করা ঝাঁঝালো উপকরণ ব্যবহার করে খাবারকে অধিক সুস্বাদু করা হয়ে থাকে। আর তাদের এই উপকরণ গুলো এসেছে উত্তর আফ্রিকার ইবেরিয়া থেকে। 

ইউরোপ ত্যাগ করার পূর্বে মুর সম্প্রদায় ইউরোপিয়ানদের খাবারের আরো একটি চমৎকার খাবার যোগ করে গেছে। ভ্যালেন্সিয়ার সামুদ্রিক খাবার এবং এর সাথে ছোট দানার চাল ও অন্যান্য অনেক উপাদান যোগ করে তৈরি করা হয় স্যাফ্রন এর ঘ্রানযুক্ত রিসোটো মিলানেজ। এছাড়াও এই মুর সম্প্রদায় ইউরোপ থেকে যাওয়ার পূর্বে ইউরোপিয়ানদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে তাদের জন্য রেখে গেছে কাটাপ্লানা নামের এক ধরনের পাতিল এর মত যন্ত্র যেটি দিয়ে তারা এই চমৎকার এবং সুস্বাদু খাবারগুলো তৈরীর জন্য পরিমাণ মত ভাপ এবং বাষ্প দিতে পারে।

এমনি করে নানা এলাকা থেকে নানা ধরনের খাবার এবং সেগুলো তৈরি করার যন্ত্র কিংবা উপাদান ইউরোপিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। এগুলো যেমন করে ইউরোপিয়ানদের নিজেদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে তেমনি এই চমৎকার খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস সেখানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদেরও আকর্ষণ করতে খুবই সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। আর এই খাবার এবং খাদ্যাভ্যাস এর মাধ্যমে এখানকার অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে একটি জাতির খাদ্যাভ্যাস তাদের অতীত এবং বর্তমান কে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরে। কিংবা অন্যান্য জায়গার খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের খাবারের অতীত এবং বর্তমান নিয়ে জানতে হলে আমাদের এই দেশ বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের বাকি লেখাগুলো পড়তে থাকুন। পরবর্তীতে আমরা আফ্রিকা, এশিয়া এবং অন্যান্য জায়গার খাদ্যাভ্যাস নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। 

জর্জিয়ার তিবলিসির সিল্ক রোড থেকে শুরু করে পর্তুগালের আলেন্তেজোর আগ্নেয়গিরি সাথে নিয়ে স্কটল্যান্ড এর মরিচের উঁচু ভূমি সহ পুরো ইউরোপ জুড়েই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংস্কৃতি এবং খাবার ও খাদ্যাভ্যাসের এক অপূর্ব সমাহার এর বৈচিত্র্যময় মেলা। এ মহাদেশের প্রতিটি খাবার টেবিলে রয়েছে বিশাল সাম্রাজ্য ও  বাণিজ্যের অপূর্ব ফল। এখানে যেমন নিজেদের তৈরিকৃত খাবার আসে তেমনি উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকা থেকে বিভিন্ন রকমের মাংস, মাছ, সবজি,  ফলমূল এবং রান্নার বিভিন্ন উপকরণ ও উপায় এসে জড়ো হয়। আর এসব মিলেই ইউরোপের জাতিগত খাদ্যাভ্যাস এবং এখানকার খাবারসমুহকে করে তুলেছে এককথায় অনন্যসাধারণ।

একটি বিশেষ খাবারের স্বাদ অন্য কোন স্থানে গেলে তা কমে আসে। যেমন গ্রীকে জন্মানো ফাভা শিম অন্য কোন দেশের বা মহাদেশের মাটিতে জন্মানোর চেষ্টা করা হলে তার প্রকৃত স্বাদ একদমই থাকেনা। ঠিক একই ভাবে বলা যায় ইতালিয়ান পাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে যে উপাদানগুলো সেখানকার নিজস্ব ভূমিতে উৎপাদন করা হয়ে থাকে সেগুলো অন্য কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলে কিংবা উৎপাদন করা হলে সেগুলো থেকে তৈরিকৃত পাস্তা ইতালিয়ান পাস্তার মত এত সুস্বাদু পাস্তা হয় না। একইভাবে রোমান আর্টিচোক অন্য কোথাও তৈরি করার চেষ্টা করলে তার গুণগতমান হয়তো ঠিক থাকে কিন্তু তাদের বেলায় প্রকৃত স্বাদ এর ধারে কাছে ঘেষতে পারেনা।

উষ্ণ পানি কিংবা ঠান্ডা, মিষ্টি কিংবা লবণাক্ত -  সমুদ্র, লেক কিংবা নদী, বিভিন্ন উপাদান এবং এখানকার পরিবেশ ইউরোপে তার নিজস্ব চমৎকার সব খাবার তৈরির মূল উপকরণ হিসেবে প্রভাব রাখে। এগুলোর কারণেই ব্রাসেলস এর বাষ্পীয় ঝিনুক থেকে শুরু করে উত্তর সাগর পাড়ের মাছ ভাজার মতো সুস্বাদু খাবারের প্রস্তুত করন করা হয় এখানে। ক্রোয়েশিয়ার স্ফটিক অ্যাড্রিয়াটিক পানিতে  থাকা স্ক্যাম্পিকে  টমেটো রসুন এবং হোয়াইট ওয়াইন দিয়ে রান্না করলে তা যে কি পরিমান সুস্বাদু হয় তা বলে বোঝানোর মত নয়। কাস্পিয়ান সাগর এর স্টারজন মাছ সুস্বাদু ক্যাভিয়ার এর মত চমৎকার খাবার উৎপন্ন করতে সাহায্য করে এবং নরওয়ের বরফময় নদীর উপকূল থেকে যে গোলাপি বর্ণের মাংস সহ স্যালমন মাছ পাওয়া যায় সেগুলো লবণ মুক্ত তীব্র সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে সাহায্য করে।

পুরো ইউরোপ জুড়ে তার বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান নদী কিংবা সাগর থেকে প্রাপ্ত মাছ কিংবা সেখানকার অন্যান্য রান্নার উপকরণ দিয়ে খাবার তৈরি করা হয় সেগুলোর সুস্বাদু গুণ এবং অন্যান্য নানা কারণে সেখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে সহায়তা করে। আর এই সুস্বাদু খাবার গুলো যখন একজন পর্যটক সেখানে ঘুরতে গিয়ে টেস্ট করে দেখেন তখন সেখানকার চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য অবলোকন করার পাশাপাশি এই সুস্বাদু খাবার গুলো পর্যটক এর মনে গেঁথে থাকে। এতে করে নিজ দেশে ফিরে গেলেও পর্যটক এর ইউরোপের সেই খাবারগুলো স্মৃতি মনে থাকে এবং তিনি সে সম্পর্কে অন্যদের জানাতে পারেন।

ইউরোপের কিছু খাবার এবং সেখানকার কিছু খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আমরা এই লেখায় জানলাম। তাদের খাদ্যাভ্যাস এর বাকি ব্যাপার গুলো সম্পর্কে আমরা পরবর্তী লেখাগুলোতে জানানোর চেষ্টা করব। 

দেশ-বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের আগের পর্বে আমরা দেখেছি চাইনিজদের খাদ্যাভাসের সম্পর্কে কিছু তথ্য। এই পর্বে আমরা চাইনিজদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বিশেষ করে তাদের খাবার খাওয়ার সময় যে অভ্যাস গুলোর সেগুলো নিয়ে আপনাদের কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করব।

সাধারণত বিভিন্ন দেশের খাবার জন্য বিভিন্ন রকমের খাদ্যাভ্যাস থাকে। আপনার দেশে হয়তো চাইনিজ খাবার কিংবা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থাকতে পারে কিন্তু চীনে সেই খাবার কিংবা সেখানকার রেস্টুরেন্ট এর ব্যাপার গুলো পুরোটাই আলাদা। আপনি যদি কখনো চীনে ঘুরতে যাওয়ার কথা পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে এই তথ্যগুলো চাইনিজদের খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্কে আপনাকে জানতে এবং মনে রাখতে সাহায্য করবে।

১. চাইনিজরা সাধারণত খাবার খাওয়ার জন্য চপস্টিক ব্যবহার করে। তারা খাবার খাওয়ার জন্য কখনওই কাটা চামচ কিংবা ছুরি ব্যবহার করেনা। তবে চিন্তার কিছু নেই আপনি যদি চীনে টুরিস্ট হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনাকেও খাবার খাওয়ার জন্য চপস্টিক ব্যবহার করতে হবে না। আপনি চাইলেই হয়তো বা রেস্টুরেন্ট থেকে আপনি  কাটা চামচ কিংবা ছুরি দেয়া হবে।

২. উত্তর চায়নায় সাধারণত চাইনিজ মানুষরা গমের তৈরি নুডুলস তাদের প্রধান খাবার হিসেবে খেয়ে থাকেন যেখানে দক্ষিণ চায়নায় চাইনিজরা প্রধান খাবার হিসেবে ভাত খেয়ে থাকে। তবে দক্ষিণ চায়নায় নুডুলস পাওয়া যায় এবং সেগুলো সাধারনত চাল দিয়ে তৈরি করা নুডুলস। 

৩. চীনে ভাগাভাগি করে খাওয়ার ক্ষেত্রে ভাত সাধারণত আলাদা করে ছোট বোল এ দেয়া হয়। মাংস বা সবজির তরকারি গুলো সাধারণত প্লেটে কিংবা বড় বোল এ দেয়া হয় যাতে করে সেখান থেকে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতে পারেন। পশ্চিমাদের মতো প্রতিজনের জন্য একটি করে প্লেট দেয়া হয় না।

৪. চাইনিজ খাবার গুলো আবার পুরো চায়না জুড়ে একেক জায়গায় একেক রকম হয়। চীনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের আঞ্চলিক খাবার রয়েছে যেগুলোর স্বাদ - ঝাল, মিষ্টি, টক আলাদা হয়ে থাকে। 

৫. চীনে রেস্টুরেন্টে খেতে বসার সময় যদি চার জনের বেশী মানুষ হয় তবে সে ক্ষেত্রে গোলটেবিল দেয়া হয় এবং টেবিলের মাঝে একটি লেজি সুসান গ্লাস দেয়া হয়ে থাকে যেটি দিয়ে টেবিলের মাঝ থেকে সহজেই খাবার নেয়া যায়। 

৬. চাইনিজ খাবারের উপকরণগুলো বিভিন্ন রকমের হয় এবং বাইরের মানুষদের জন্য সেগুলো বেশ জঘন্য লাগতে পারে। যেমন তারা রান্নার উপকরণ হিসেবে ব্যাঙ, মুরগির পা, শুকর এর কান, কুকুরের মাংস এগুলো ব্যবহার করে থাকে।

৭. সেখানে সাধারনত খাবার টেবিলে লবণ কিংবা মরিচ গুড়ার বোতল অথবা টমেটো সসের বোতল থাকে না। বরং সেখানে খাবার টেবিলে সয়া সস, ভিনেগার এবং মরিচের পেস্ট পাওয়া যায়।

৮. কিছু কিছু চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চিৎকার-চেঁচামেচি চলতে পারে যেহেতু সে সব জায়গায় মানুষজন তাদের কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর নিচু করে না এবং কিছু জায়গায় ধূমপানের কারণে রেস্টুরেন্ট ধোঁয়াটে অবস্থায় থাকে। তবে সম্প্রতি জনসম্মুখে ধূমপান করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

৯. চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সাধারণত বেহারাদেরকে টিপস দিতে হয়না কারণ সেখানে খাবারের মূল্য সাথেই তাদের সার্ভিস চার্জ যুক্ত থাকে।

১০. যদি আপনার কোন চাইনিজ বন্ধু খাবার খাওয়ার সময় আপনার প্লেটে খাবার তুলে দেয় তার মানে এই নয় যে সে ক্ষেপে না পেরে আপনাকে দিতে চাইছে বরং এটি তাদের বন্ধুত্ব এবং কাছে আসার একটি চিহ্ন। এই ব্যাপারটি সাধারণত পরিবারের সবার সাথে খাওয়ার ক্ষেত্রে ঘটে থাকে কারণ এর মাধ্যমে ছোটরা বড়দেরকে সম্মান এবং বড়রা ছোটদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। 

দেশ-বিদেশে খাদ্যাভাস সিরিজ এর এই পর্বে আমরা চীনের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কিছু তথ্য জানলাম। পরবর্তী পর্বে আমরা অন্য কোন একটি দেশ বা জাতির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আরো কিছু তথ্য আপনাদেরকে জানানোর জন্য চেষ্টা করব। 

চীনের খাবার নিয়ে সারা বিশ্বে একটি চমৎকার প্রবাদ আছে সেটি হচ্ছে,

“ফ্যাশনের জন্য ইউরোপ, থাকার জন্য আমেরিকা আর খাবারের জন্য চীন।”

চাইনিজ দের জন্য খাবার প্রাত্যহিক জীবনের একটি  খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চাইনিজরা শুধু তাদের খাবারের প্রয়োজন এই খাবার খায় না বরং তারা মনে করে যে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে তারা সমাজে একটি সাম্যবস্থা তৈরি করতে পারবে এবং একইসাথে এর কারণে তাদের পরিবার এবং অন্যান্য সম্পর্ক ভালো থাকে।

চাইনিজরা তরতাজা খাবার পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই তাদের রান্নার উপকরণ গুলো কেনাকাটা করতে যায়। চাইনিজরা তাদের খাবার তরতাজা হওয়ার জন্য সাধারণত জীবন্ত সামুদ্রিক খাবার, তরতাজা মাংস, মৌসুমী ফল এবং শাকসবজি পছন্দ করে আর এগুলো তারা তাদের লোকাল মার্কেট থেকে কিনে যাতে করে সেগুলো সত্যিকার অর্থেই তরতাজা হয়ে থাকে। এগুলোর মাঝে পড়ে সাঁতার কাটে এরকম মাছ, জীবন্ত কাঁকড়া এবং হাঁস-মুরগি। এমনকি যদি রান্না করা খাবার হয় যেমন হাঁসের বারবিকিউ তবে সেটিতেও এমনভাবে বাষ্প উঠতে হয় যেন মনে হয় মাত্র রান্না করা খাবারটিকে ওভেন থেকে বের করা হয়েছে।

চাইনিজরা সাধারণত খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব গুলোর মত খাবারের পুষ্টিমান সম্পর্কে সচেতন থাকে না। খাবারের পুষ্টিমান এর চাইতে তারা খাবারের রঙ, স্বাদ এবং গন্ধের দিকে বেশি মনোযোগী হয়। চাইনিজ মানুষদের রান্নার ক্ষেত্রে এই বিষয় গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাইনিজদের দৈনিক খাবারের ক্ষেত্রে চারটি বিষয় লাগে সেগুলো হচ্ছে শস্য, তরিতরকারি, ফল এবং মাংস। যেহেতু চাইনিজরা ল্যাকটোজ সহ্য করতে পারেনা সেজন্য তারা সাধারনত দুগ্ধজাত খাদ্য পরিহার করে থাকে। আর এই দুগ্ধজাত খাবার এর পরিবর্তে চাইনিজরা ছয়ামিল্ক এবং টোফু খায়। কারণ এগুলোতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম থাকে। 

চাইনিজদের খাবার এর প্রধান উপাদান শাকসবজি, ফল মূল এবং মাংস সাধারণত বেশ সতেজ থাকে। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে বলা যায় কিছু ফ্রোজেন খাবারের কথা যেখানে কিছু শাকসবজি এবং অন্যান্য খাবার কে সংরক্ষিত করে ঠান্ডা হিসেবে রাখা হয়। তবে সাধারণত ক্যানের কিংবা ফ্রোজেন খাবার চাইনিজরা খুব কমই খেয়ে থাকে। 

তবে চাইনিজদের রান্নার ক্ষেত্রে সাধারণত গভীর তেলে ভেজে রান্নার ব্যাপারটা পরিহার করা হয়। তবে আমেরিকাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এবং পুরো বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গভীর তেলে ভেজে রান্না করার যে ব্যাপারটি এসেছে মূলত শুকর, মুরগি এবং চিংড়ি ভেজে সেগুলো সুস্বাদু করতে এবং পশ্চিমা বিশ্বের মানুষদের খাবারের মাধ্যমে মনোরঞ্জন করতে। আর এ কারণে সাধারণত বোঝা যায় ঠিক কি কারণে চাইনিজ সভ্যতার চাইতে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষদের কেন এত উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের ব্যধিতে আক্রান্ত হতে হয়। 

দেশ-বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজ এর এই পর্বে আমরা দেখলাম চাইনিজদের কিছু খাদ্যাভ্যাস যেখানে তাদের খাবার এবং সেগুলো খাওয়ার উপায় গুলো সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য আপনাদের জানানো হলো। দেশ-বিদেশে খাদ্যাভ্যাস সিরিজের পরবর্তী পর্বে আমরা আপনাদেরকে চাইনিজদের খাদ্যাভ্যাসের আরো বিশেষ কিছু তথ্য জানানোর চেষ্টা করব।